• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

ডায়রিয়া রোগী সামলাতে হিমশিম

  • ''
  • প্রকাশিত ১৮ এপ্রিল ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক:

সারাদেশে বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ। প্রতিদিনই তাপমাত্রার নতুন নতুন রেকর্ড হচ্ছে। তীব্র গরমে ডায়রিয়া, সর্দি-কাশিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই যে অবস্থা তৈরি হয়েছে তাতে বোঝা যাচ্ছে, এবছর ডায়রিয়া পরিস্থিতি সামলানো কঠিন হবে।

রাজধানীর মহাখালীর আইসিডিডিআর, বির অধীন ঢাকা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে ছয় বছরের শিশু নুজহাতকে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ডায়রিয়ার কারণে নুজহাতের শরীরের সোডিয়াম, পটাশিয়াম আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। তার শারীরিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে কয়েক দিন লাগতে পারে। নুজহাতের বাবা সায়মন জানান, তার আরেক মেয়েরও পেট খারাপ দেখা দিয়েছে। তাকে শিগগিরই হাসপাতালে ভর্তি করাবেন।

আইসিডিডিআর, বির এই হাসপাতালে সাধারণত প্রতিদিন গড়ে ৩০০ ডায়রিয়া রোগী চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। তবে বর্তমানে সেই সংখ্যা ৪৫০ থেকে ৫০০ জন বলে জানান সেখানকার চিকিৎসকরা। হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ১৫ জন রোগী ভর্তি হচ্ছে। গত ৭ এপ্রিল ৪৬১ জন, ৮ এপ্রিল ৪৬৯ জন, ৯ এপ্রিল ৪১৪ জন, ১০ এপ্রিল ৪২৯ জন, ১১ এপ্রিল ৪৪৯ জন, ১২ এপ্রিল ৫৯৫ জন, ১৩ এপ্রিল ৫২৫ জন, ১৪ এপ্রিল ৪৩৪ জন, ১৫ এপ্রিল ৪৯১ জন এবং আজ মঙ্গলবার (১৬ এপ্রিল) দুপুর ২টা পর্যন্ত ২৬১ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন ঢাকা হাসপাতালে। অর্থাৎ গত ১০ দিনে ৪ হাজার ৫২৮ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন।

চিকিৎসকদের মতে, রাজধানীসহ সারা দেশ প্রচণ্ড দাবদাহের মধ্যে রয়েছে। ছোট বড় সবাই গরমে কাবু হচ্ছে। আর তাতে শরীরে পানির চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে পানির মাধ্যমে ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়ছে। হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাধারণ সময়ের তুলনায় এখন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। হাসপাতালে আসা রোগীর বেশিরভাগই শিশু। এমনকি ঈদের ছুটি শেষে রাজধানীতে জনসমাগম বাড়লে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা আরও বাড়বে বলে শঙ্কা করছেন চিকিৎসকরা।

যাত্রাবাড়ী থেকে ১৭ মাস বয়সী শিশু মিনহাজকে নিয়ে আইসিডিডিআর, বির হাসপাতালে আছেন তার মা রোকসানা। বেডে বসে সন্তানকে স্যালাইন খাওয়াচ্ছিলেন তিনি। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়েক দিন ধরেই ছেলের বমি আর পাতলা পায়খানা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে ওষুধ সেবন করালেও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। শরীর একেবারে দুর্বল হয়ে পড়ছে। বুকের দুধও নিচ্ছে না। এরপর হাসপাতালে নিয়ে আসেন তিনি। হাসপাতালেই কেটেছে তাদের ঈদ।

রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর থেকে দেড় বছরের শিশু ফারিনকে নিয়ে আইসিডিডিআর, বি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন বাবা রাশেদুল ইসলাম। তিনি আশঙ্কা করছেনÑ তীব্র গরমের কারণেই তার সন্তান ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ডায়রিয়া পানিবাহিত রোগ। দূষিত পানি পান করার মাধ্যমে এই রোগ হয়। সাধারণত দিনে কারও তিন বা তার চেয়ে বেশিবার পাতলা পায়খানা হলে তার ডায়রিয়া হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। গরম এলেই ডায়রিয়ার সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করে। বিশেষ করে শিশু-কিশোররা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শহরে টেপের পানি সেপটিক ট্যাংক বা সুয়ারেজ লাইনের সংস্পর্শে এসে দূষিত হয়। অস্বাস্থ্যকর ও অপরিচ্ছন্ন জীবনযাপন, যেখানে-সেখানে ও পানির উৎসের কাছে মলত্যাগ, সঠিক উপায়ে হাত না ধোঁয়া, অপরিচ্ছন্ন উপায়ে খাদ্য সংরক্ষণ এবং ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে দোকান, রেস্তোরাঁ বা বাসায় পচন ধরা ফ্রিজের খাবার খাওয়া ডায়রিয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।

আইসিডিডিআর, বির অ্যাসিসট্যান্ট সায়েন্টিস্ট শোয়েব বিন ইসলাম জানান, গত কয়েক দিনের অসহনীয় গরমে রোগীর চাপ অনেক বেড়েছে। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন গড়ে ২৫০-৩০০ রোগী ভর্তি হন। এখন তা ৫০০ ছাড়িয়েছে। এখনও অনেকে ঈদের ছুটি কাটিয়ে ঢাকায় ফিরে আসেনি। বর্তমানে যে তাপমাত্রা বিরাজ করছেÑ তা অব্যাহত থাকলে রোগীর চাপ আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

গরমের সময়ে ডায়রিয়া বা পানিবাহিত রোগ থেকে কীভাবে নিরাপদ থাকা যায় এ বিষয়ে হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা নানা পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

আইসিডিডিআরবির চিকিৎসকরা জানান, ডায়রিয়া থেকে তাৎক্ষণিক আরোগ্য লাভ হয় না। নিয়ম মেনে খাবার স্যালাইন আর ওষুধ খেলে ডায়রিয়া ধীরে ধীরে ভালো হয়।

এদিকে, রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট (শিশু হাসপাতাল), মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহে এসব হাসপাতালে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। গত কয়েকদিনের গরমে শুধু ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর শিশু হাসপাতালে ভর্তি আছে দুই শতাধিক শিশু। মুগদা হাসপাতালের শিশু বিভাগেও ইতোমধ্যে রোগীতে সব শয্যা পূর্ণ হয়ে গেছে।

প্রচণ্ড এ গরমের মধ্যে শিশুদের সুরক্ষায় যথাসম্ভব বাসায় রাখার পরামর্শ দিয়েছেন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. নিয়াতুজ্জামান। তিনি বলেন, গত কয়েকদিনের গরমে শিশুদের কষ্ট বেশি হচ্ছে। এ গরমের কারণে ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। এক্ষেত্রে অন্যান্য বয়সীদের তুলনায় শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি। বর্তমানে আমার হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে শুধু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশু ভর্তি আছে ১৬ জন। এছাড়া জ্বর, সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়ার রোগী তো আছেই। অন্যান্য সময়ের তুলনায় আক্রান্তের এ হার আমরা অস্বাভাবিক বলছি।

তিনি বলেন, প্রচণ্ড রোদ ও গরমে শিশুদের যথাসম্ভব বাসায় রাখার চেষ্টা করতে হবে। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কোনোভাবেই যেন তাদের বাইরে বের করা না হয়। কারণ, গরমে বাচ্চারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাইরে বের হলে অবশ্যই বাসা থেকে বিশুদ্ধ পানি নিতে হবে, প্রয়োজনে ছাতা ব্যবহার করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, যত্রতত্র পানি বা রাস্তার পাশের খোলা জুস, শরবত বা আইসক্রিম শিশুদের খাওয়ানো যাবে না। বাজারে এখন নানা ধরনের ড্রিংকস কিনতে পাওয়া যায়। সেগুলো বিশুদ্ধ পানি দিয়ে তৈরি কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

সতর্কতার পরামর্শ দিয়ে মুগদা হাসপাতালের পরিচালক বলেন, ঈদ-পরবর্তী সময়ে ফুড পয়জনিং (খাদ্যে বিষক্রিয়া) রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। একই সঙ্গে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও আমরা বেশি পাচ্ছি। এজন্য অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি বাসায় পানি খাওয়ানোর ক্ষেত্রেও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যতটুকু সম্ভব পানি ফুটিয়ে, এরপর ফিল্টার করে পান করা নিরাপদ।

তীব্র গরমের এ সময়ে শিশুদের ঘাম যেন গায়েই না শুকায়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্ট শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো. আজিজুল ইসলাম।

তিনি বলেন, হঠাৎ করে মাত্রাতিরিক্ত গরম পড়ার কারণে বাচ্চাদের শরীরে ঘাম বেশি হয়। ঘামটা যখন তাদের শরীরে শুকায় তখনই বাচ্চাদের সর্দি-কাশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য ঘাম হলে সাথে সাথে শুকনা কাপড় দিয়ে মুছে দিতে হবে। পাশাপাশি পানি ও তরল জাতীয় খাবার বেশি বেশি খাওয়াতে হবে।

‘বর্তমানে অতিরিক্ত গরমে ডায়রিয়ার পাশাপাশি সর্দি-কাশি নিয়েও অসংখ্য রোগী আমাদের কাছে আসছেন। একটু সিরিয়াস অবস্থা হলেই রোগীরা আমাদের কাছে আসেন। এর বাইরেও অসংখ্য রোগী বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তারা স্থানীয় ফার্মেসিগুলো থেকে ওষুধ এনে খাচ্ছেন। খোঁজ নিলে দেখতে পাবেন, রাজধানীর প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে বাচ্চারা কোনো না কোনো অসুখে আক্রান্ত।’

তিনি আরও বলেন, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার প্রধান কারণ হলো বাইরের খাবার। এখন বাইরে প্রচণ্ড ধুলাবালি থাকে, যেগুলো বাতাসের মাধ্যমে উড়ে গিয়ে খাবারে গিয়ে পড়ে।

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, বেশি গরমের কারণে শুধু শিশুরাই নয়, বড়রাও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে গরমের সময় যারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাইরে কাজ করেন তাদের জন্য ঝুঁকিটা একটু বেশি। তারা ডিহাইড্রেশন (পানিশূন্যতা) ঝুঁকিতে থাকেন, হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হন; ডায়রিয়া আর সর্দি-কাশি তো আছেই। এজন্য একটানা এক ঘণ্টার বেশি রোদে থাকা যাবে না। প্রচুর পরিমাণ পানি পান করতে হবে। সম্ভব হলে পরিমাণ মতো লবণ মিশিয়ে পান করা উচিত। আরও ভালো হয় যদি দু-একটা ওরস্যালাইন খাওয়া যায়। কারণ, গরমে ঘামের সঙ্গে শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে লবণ বের হয়ে যায়। শুধু পানি পান করলে সেটা অনেক সময় ঘাটতি পূরণ করতে পারে না। তাই লবণ মিশিয়ে পানি পান করলে উপকার পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads